চিত্রাংয়ের তাণ্ডবে জীবন নাশ হলো কিশোরগঞ্জের ওইতিহাসিক বটতলার একটি বটবৃক্ষের !!
গত ২৪অক্টোবর,সোমবার(২০২২),দিবাগত রাত ১১ঃ১০ঘটিকায় কিশোরগঞ্জে ঘুর্ণিঝড় চিত্রাং এর তাণ্ডবে উপড়ে পড়েছে শহরের বটতলার মোড়ের প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এক বটবৃক্ষ। বটগাছটি উপড়ে পড়ায় এখন স্থানীয় লোকজন সহ পথচারীরাও আক্ষেপ প্রকাশ করছেন।
২৫অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় চিত্রাং কৃত বটবৃক্ষের এই ধ্বংসলীলা দেখতে ঘটনাস্থল দেখতে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ভীড় জমান সকাল থেকেই। ওৎসুক্য এলাকার জনগণ তথা পথচারী,রিকসা শ্রমিক,সিএনজি-মটর-ট্রাক ও মাইক্রো চালক,লেখক-কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিককর্মী-বনজকর্মী,সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ অগনিত শোকাভিভূত মানুষ ছুটে আসেন এই ওইতিহাসিক বটতলায়। একজন নেতার মৃত্যু হলে একটি অঞ্চলে যেমন শোকের ছায়া নেমে আসে, তেমনি মানুষের ঠিকানা ও ছায়াপ্রদাকারী এ বটবৃক্ষের যবনিকাপাতে গোটা কিশোরগঞ্জেও নেমে আসে শোকের সেই ছায়া। এই বটবৃক্ষটি যে কত মানুষের ঠিকানা ছিল তা কে জানে?বৃক্ষপ্রেমিকদেরও বিষন্নতা ছিল চোখে পড়ার মতো। একটি ইতিহাসের সমাপ্তিতে তা স্মৃতিময় করে রাখার জন্য যে যেভাবে পারে সেইভাবেই বটবৃক্ষের ধ্বংসলীলার স্থিরচিত্র ধারণ করে রাখে যার যার মোবাইল সেটে।
এ বটবৃক্ষের নিচে ৪৫বছর ধরে জুতো পালিশ করে আসা মুচি নারায়ন রবি দা বলেন, উপড়ে পড়া গাছটির ছায়ায় আমি মানুষের জুতো সিলাইয়ের কাজ করতাম। জীবিকা নির্বাহের এক উৎসস্থল ছিল এ বৃক্ষের গোড়া। সেখানে সেই যে অর্থ ইনকাম করতাম সেই অর্থ দিয়েই চালিয়ে আসছিলাম আমাদের সংসার। আমার সেই আর্থিক উৎসস্থলের ধ্বংসলীলা দেখে আমি যেন নিজকে সামলাতে পারছিনা। ৪৫বছরের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার এখানকার কর্মজীবনে তার কোনো শেষ নেই। আজ আমি ভারাক্রান্ত,বেদনাহত ও শোকাভিভূত। স্থানটি যেমন ফাঁকা হয়ে গেছে তেমনি আমার জীবনটাও যেন ফাঁকা হয়ে গেছে।"
উপড়ে পড়া এ বটগাছটির নামেই এখানকার মোড়কে বলা হয় বটতলার মোড়। পূরণো এ বটগাছটিকে ঘিরে কত জনের রয়েছে কত স্মৃতি। তাই বটতলা নামটি অক্ষুণ্ন রাখতে একই জায়গায় যেনো আরেকটি বটের চারা রোপন করা হয় সেই মতামত দিচ্ছেন সুধীজনরা।
এ গাছটি উপড়ে যাওয়ায় কারো কারো বিরূপ মন্তব্যও শোনা যায়। কেহ কেহ বলছেন বটবৃক্ষের জড় কেটে মোড়ের ঝর্ণা স্থাপন করায় গাছটি আরো বেশি দূর্বল হয়ে পড়ছিলো।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সোমবার দিবাগত রাতে উপড়ে পড়ে বটগাছটি। এ সময় গাছের নিচে কোন লোক ছিল না বিধায় কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে গাছের নিচে ট্রাফিক পুলিশের পুলিশ বক্স ও একটি চায়ের দোকান ভেঙে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, বটগাছটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এখানকার বাজার। গাছটির কারণেই এ জায়গার নামকরণ হয় ‘বটতলা মোড়’, যা এখন ‘হাসপাতাল বটতলা মোড়’ নামে পরিচিত। তাঁরা বলেন, এ গাছটি শুধু ঐতিহ্যবাহীই ছিলনা; এটি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি শতশত পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত ছিল।
এক বৃদ্ধ বলেন, ‘নরসুন্দা নদীর কিনারে ছায়াঘেরা এ বটগাছের নিচে বসে অনেকেই বসন্তের নির্মল বাতাস উপভোগ করেছেন।’
অনেক পথচারীরা জানান, কিশোরগঞ্জ শহরের ইতিহাসের সাক্ষী এই বটগাছ। এ গাছটি হঠাৎ ভেঙে পড়ায় এমন ইতিহাস অনুসিন্ধুৎসুদের মন অধিকতর খারাপ হয়েছে। এখানে সময় কাটানো কেহ কেহ বলেনঃ এই গাছের নিচে তাঁদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। এখন বৃদ্ধকাল পার করছেন । তারা আরো বলেন, ‘গাছটি এভাবে উপড়ে পড়বে ভাবতেও পারেননি তাঁরা। এটার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। দিনে দিনে এ গাছটির শিকড় কেটে এটাকে মেরে ফেলা হচ্ছিল। ফোয়ারা নির্মাণ এবং বিভিন্ন দোকানপাট করাসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে শিকড় কেটে গাছটির গোড়া দুর্বল করে দেওয়া হয়েছিল।’
মানুষ -জীবজন্তু ও বৃক্ষরাজীর একদিন জীবন অবসান হবে এটা চিরন্তন সত্য। কিন্তু যে কোনো প্রাণীকে মৃত্যুকে দিকে ঠেলে দেয়ে নিছক হত্যাকান্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।