আজ ২রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জল্লাদ শাহজাহান কারামুক্ত! মিডিয়ায় তার অনুভুতি! অতঃপর তার পরিচয় !!

রেজাউল হাবিব রেজাঃ

অবশেষে দীর্ঘ ৩২ বছর কারাভোগের পর রোববার বেলা পৌনে ১২টায় কারা ফটক থেকে বেরিয়ে আসেন ৭৩ বছরের শাহজাহান। যখন কারাগারে গিয়েছিলেন তখন বয়স ছিল ৪০ এর কোঠায়। তখনও বিয়ে করেননি। সাদা প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে বাইরে এসে বলেন, খুব ভালো লাগছে।

এ সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে জল্লাদের কাজ দিয়েছিলো। আমি সাহসী ছিলাম বলেই, এই কাজ পেয়েছিলাম। কাজটি আমি না করলে কেউ না কেউ করতেন। এখন আমি চলে এসেছি, এ কাজ অন্যরা করবেন।

কারা কর্তৃপক্ষ  তাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে জানিয়ে শাহজাহান বলেন, আমি সেখানে (কারাগার) ভালো ছিলাম। তিনি অতীতে যত অপরাধ করেছেন, সে জন্য সাজা খেটেছেন। কারাবাস তাকে পরিশুদ্ধ করেছে। এখন একটাই চিন্তা, কীভাবে ভালোভাবে চলব।

কারাগারের রেকর্ড বলছে, ২০০১ সাল থেকে মুক্তির আগ পর্যন্ত জল্লাদ শাহজাহান ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন। যদিও তার দাবি এই সংখ্যা ৬০। তবে যেটিই হোক, সব পরিসংখ্যানে দেশের ইতিহাসে সব থেকে বেশি ফাঁসি দেওয়ার রেকর্ড জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়ার।

তিনি যাদের ফাঁসি কার্যকর করেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনি, জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর কাসেম আলী ও জেএমবির দুই জঙ্গি বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানী।

শাহজাহান ভূঁইয়ার জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরিচিতি পান ডাকাত হিসেবে।

শাহজাহারের তিন বোন, এক ভাই। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া ও মা মেহের। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত। ১৯৭৪ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন। নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন শাহজাহান।

একবার তার গ্রামে নারীঘটিত ঘটনায় দুই বন্ধুসহ শাহজাহানের নামে অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে গ্রামে বিচারে বসে। বিচারে অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় সাজা হয় তার। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে বদলা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেনে। অপরাধ জগতে জড়িয়ে চরম প্রতিশোধ নেয়ার খেলায় মেতে ওঠেন তিন।

সেই ধারায় ক্রমেই দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী তালিকায় নাম উঠে যায় শাহজাহানের। তার উল্লেখযোগ্য একটি ডাকাতির অপারেশন ছিলো ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়। আর এটাই ছিলো তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। কারণ, এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত ধরা পড়তে হয় তাকে।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে যান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয় কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন, পথিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে ফেলে। তার গতিময় জীবনের এখানেই সমাপ্তি এবং এরপর থেকে তার বন্দী জীবন শুরু।

রেকর্ড অনুযায়ী দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত শাহজাহান ভূঁইয়া। একটি ডাকাতি করতে গিয়ে হত্যা মামলা এবং আরেকটি অস্ত্র আইনে মামলা। এ দুটি মামলায় ১৯৯১ সালের ১৭ মে থেকে কারাগারে আছেন। দুই মামলায় তার সাজা হয়েছিল ৪২ বছর।

এর মধ্যে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে অস্ত্র আইনে মামলায় তার ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার অনাদায়ে আরও ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। আর হত্যা মামলায় তার ৩০ বছরের সাজা হয় এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাস কারাদণ্ড হয়।

এই দুই মামলায় ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন রেয়াত পেয়েছেন তিনি। শাহজাহানের হাতে কোনো টাকাপয়সা না থাকায় যে ১০ হাজার টাকা তাঁর দণ্ড হয়েছিল, তা কারা কর্তৃপক্ষ মিটিয়ে দিয়েছে।

সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে শাহজাহান জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এরপর কারাগারে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় আসলেই ডাক পড়তো তার। টানা আট বছর এই কাজ করার পর কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category